ইসলামি পোশাক কেমন?

ইসলামি পোশাক কেমন?
বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে ইদানিং খুব বেশি চর্চা হচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু একটা দেশের সার্বিক চিত্র বিবেচনা করলে ধর্মের থেকে অধর্মের চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই প্রমাণ হয়। আমরা শিখবো, কিন্তু কার কাছে থেকে শিখবো? সন্দেহাতীতভাবে যিনি জ্ঞান রাখেন, প্রজ্ঞাবান তার কাছ থেকে শিখবো। কিন্তু ইদানিং ধর্ম সভাগুলোতে এক শ্রেণির কৌতুক অভিনেতার আগমন ঘটেছে। ভালো বক্তার কদর দিনকে দিন কমে এইসব তথাকথিত অর্ধশিক্ষিত তালেবে এলেম ধর্ম শিক্ষা দানের থেকে ধর্মের ব্যবসা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ বেশি দিচ্ছেন। তাই তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে একটা দেশের সংস্কৃতি, মানুষের রুচির সাথে বিরোধ তৈরি করছেন। মানুষকে তাদের মত করে তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছেন। এভাবে যারা বিভ্রান্তি ছড়ায় তাদের বিষয়ে ইসলাম কী বলে তা আজকের আলোচনার বিষয় নয়। আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে ইসলামি পোশাক! ইদানিং অনেক মৌলানা সাহেবগণ বলে থাকেন ইসলামি পোশাক বলে একটা কিছু আছে। মানে আরবের লোকজন যে ধরনের কাপড় পরে তাই হচ্ছে ইসলামি পোশাক। কিন্তু অনেক অভিজ্ঞ আলেম বলে থাকেন ইসালিম পোশাক বলে আসলে কিছু নাই। ইসলাম ধর্মে এমন কোন ইউনিফর্মের কথা বলা হয়নি যে, তাই হবে ইসলামি পোশাক। এটা পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য একই। পবিত্র কোরআন ও হাদিস ঘেটে এমন ইসলামি ইউনিফর্ম বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায় না।

পঞ্জাবি কী ইসলামি পোশাক?
অনেকে মনে করে থাকেন পাঞ্জাবি বোধহয় ইসলামি পোশাক! আদতে কী তাই। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ আরও কিছু দেশে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান অনেকেই পাঞ্জাবি নামের এই পোশাক পরিধান করে থাকেন। লম্বা দাড়ি ও পাঞ্জাবি পরার কারণে নির্মলেন্দু গুণকে কী মুসলিম বলবেন? বড় বড় জোব্বা তো প্রাক ইসলাম যুগেও পরা হয়েছে। নবীর বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছেন তারাও তো বড় বড় জোব্বা পরতেন বলেই আরব ইতিহাসে পাওয়া যায়।

টুপি কী শুধু মুসলমানরাই পরে?
টুপিকে বাংলাদেশের অনেকে ইসলামি সিম্বল হিসেবে ভেবে থাকেন। আসলেই কী তাই। টুপি কী শুধু মুসলমানরাই পরে থাকেন? ইহুদি পুরোহিতরা মাথায় টুপি পরে। ইহুদিরা ইবাদতের সময় টুপি পরে। পৃথিবীতে হিন্দু ধর্মের অনেককে টুপি পরতে দেখা যায়। যদিও টুপির আকার-ধরন আলাদা।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সময় কে কেমন কাপড় পরতো?
হয়রত মুহাম্মদ (সা.) সময়ে তিনি যেমন কাপড় পরতেন ইসলামের বাইরে যারা ছিলেন তারাও একই ধরনের কাপড় পরতেন। আবু জেহেলের দাড়ি ছিলো, তিনিও আরবের গরম আবহাওয়ার কারণে, লুহাওয়া থেকে বাঁচতে লম্বা জোব্বা মত কাপড় পরতেন। মাথায় পাগড়ি রাখতেন। লম্বা হাতাওয়ালা জামা পরতেন। পাগড়ি সাধারণত আরবরা ধুলি ঝড় থেকে বাঁচার জন্য পরতো যা আরবরা এখনও পরে থাকে। এটা পরিবেশগত কারণেই আরবের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের অংশ। আরবের মানুষ আরবের আবহাওয়া ও সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে কাপড় বানায় ও পরে। কাফের থেকে কেউ মুসলমান হলে হযরত মুহাম্মদ (সা.) কখনও তাকে পোশাক পরিবর্তন করতে বলেননি। কারণ যে কাফের থেকে মুসলিম হল সে আরবের সংস্কৃতি অনুসারে কাপড় পরেছিলো। তাই কাপড় পরা বিষয়ে তিনি বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করেননি। নবী মুহম্মদ (সা.) কাছে কাপড় পরার থেকে দর্শন গ্রহণ করাটাই বেশি জরুরি ছিলো। পোশাক ব্যাপারটা জাতীয়তা ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত। ইসলাম নির্দিষ্ট কোন পোশাক পরিধান করতে বলে না। কোন পোশাককে নিষেধও করে না, যদি না সেটা পোশাকের নুন্যতম নিয়মকে ভঙ্গ করে।

পোশাক পরা বিষয়ে ইসলামে কিছু নির্দেশনা আছে
ছেলেদের পোশাক সম্পর্কে বলা হয়েছে- পোশাক হবে ঢিলেঢালা। টাইট পোশাক পরা পুরুষদের জন্য হারাম। অর্থাৎ ইসলামে আরামদায়ক পোশাক পরার নির্দেশনা রয়েছে। বলা আছে নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত পুরুষদের ঢেকে রাখতে হবে। যে সকল প্যান্ট আরামদায়ক, ঢিলেঢালা, শরীরের সাথে লেপ্টে থাকে না, এমন প্যান্ট যা হাঁটুর নিম্নভাগ পর্যন্ত ঢেকে রাখে সেই সকল পোশাক ইসলামে শুদ্ধ। তেমনি রঙের বিষয়ে কিছু রঙ পরা নিষেধ আছে। অর্থাৎ পোশাক জোব্বাই হতে হবে এমন কোন নির্দেশনা নাই। সুতরাং ইসলামি পোশাক বলতে কিছু নাই। ইসলামে যেটা আছে সেটা হচ্ছে নিজের আচরণকে শুদ্ধ করার উপায়। নিজের জীবন দর্শনকে পরিবর্তনের উপায়। ইসলাম ঠুনকো পোশাকসর্বস্ব নয়। ইসলামে পুরুষদের পোশাকের বিষয়ে যেমন নির্দেশনা আছে তেমনি নারীদের পোশাক বিষয়েও নির্দেশনা আছে। মেয়েদের হাত-পা মোজা পরে, গরমে কালো বোরকায় মুড়ে থাকতেই হবে এমন না। বলা আছে শরীরকে প্রদর্শন করা যাবে না। হিজাব বা বোরকা ছাড়া অন্য কাপড়েও যদি পর্দা করা যায় সেটাতেই চলবে। অনেকে শাড়ি পরে সুন্দরভাবে নিজের শরীরকে ঢেকে রাখতে পারেন। বলা হয়েছে তোমরা তোমাদের মাথার ওপর একটা চাদর টেনে দাও। এটা সম্রান্ত নারীদের চিহ্ন।

ঘোমটা দেওয়ার সংস্কৃতি
বাংলাদেশের প্রাচিন কালের ছবি দেখলে কিংবা ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে হিন্দু ও মুসলাম উভয়েই লম্বা ঘোমটা দিত। ভারতের রাজস্থানে হিন্দু, মুসলিম নারীরা লম্বা ঘোমটা টেনে রাখে। হিন্দু নারী মাথায় ঘোমটা দেয় বলে তাকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি বলে কোন মুসলাম নারী ঘোমটা দেওয়া থেকে বিরত থাকবে না। কারণ এটি তার নিজস্ব এলাকার সংস্কৃতির শিক্ষা।

লম্বা পোশাক পরার সংস্কৃতি
প্রাচিন কালে লম্বা পোশাক পরার সংস্কৃতি ছিলো দেশে দেশে। অনেক পুরনো ছবি ও ইতিহাস ঘেটে দেখলে দেখা যাবে খ্রিস্টান রাজারা লম্বা লম্বা জামা পরতেন। যোদ্ধারা লম্বা জামা পরতেন। মুসলমানরাও লম্বা পোশাক পরতেন। এই লম্বা পোশাক পরা কোন ধর্মীয় কারণ ছিলো না। আবার দেখুন খ্রিস্টান নানরা বোরকার মত দেখতে একটি পোশাক পরেন। কিন্তু মুসলমানের বোরকাও প্রায় নানদের মত। এখন এই অজুহাতে মুসলমান মেয়েরা বোরকা পরতে পারবে না এমন নয়। সমাজের যে কোন ধরনের পোশাক পরা যাবে যদি তা ইসলামের পোশাক সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে করা হয়।

কোন ধরনের পোশাক ইসলাম পরতে নিষেধ করেছে?
যে রঙের কাপড় অন্য ধর্মের পুরোহিতদের জন্য নির্ধারিত সেই ধরনের কাপড় পরতে ইসলাম নিষেধ করেছেন। গেরুয়া রঙের পোশাক সাধারনত হিন্দু ও বৌদ্ধ যাজকরা পরে থাকেন তাই এই ধরনের পোশাক পরা থেকে মুসলমানদের বিরত থাকতে বলা হয়েছে। কারণ এই পোশাক অন্য ধর্মের সন্যাসীরা পরেন। তাই এই রঙকে না পরতে বলা হয়েছে। এখানে রঙের কথা বলা হয়েছে কাপড়ের কথা নয়। বৌদ্ধ ও হিন্দু সন্যাসীরা গেরুয়া কাপড় যেখাবে দুই খন্ডে পরেন ঠিক সেইভাবে মুসলিমরা হজ্ব করার সময়ও পরে থাকেন তবে তা সাদা কাপড়। হজ্বের বেলায় সাদা কাপড় পরার ধরনের সাথে অন্য ধর্মের সন্যাসীদের কাপড় পরার ধরনের মিল আছে কিন্তু হজ্বের বেলায় পরা হয় সাদা কাপড়। এখানে গেরুয়া রঙকে নির্দেশ করা হয়েছে। কারণ গেরুয়া রঙ ছাড়া সন্যাসীরা অন্য কাপড় পরেন না। তাই মুসলমানদের গেরুয়া কাপড় পরা ঠিক হবে না। পোশাক পরা নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে ইসলামকে ও ইসলামের দর্শনকে এক শ্রেণির মানুষ সঙ্কীর্ণ করছেন। মুসলমানরা তাদের নিজ দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী পোশাক পরতে পারবে। শুধু মাত্র পোশাক বিষয়ে কী নির্দেশনা দেওয়া আছে ইসলামে তা অনুসরণ করতে হবে।

হিজাব পরার আভিজাত্যের ইতিহাস
খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দেও মেসোপটেমিয়া, বাইজানটাইন, পারস্য গ্রীসের অভিজাত নারীরা হিজাব পরতো। সেখানকার আইন ছিল যে, অভিজাতরা হিজাব পরতে পারবে। সাধারণ নারীরা পরতে পারবে না। সেই সময়ের প্রচুর নিদর্শন থেকে পাওয়া তথ্য মতে এটাই সত্য। একসময় খ্রিস্টান, ইহুদি মেয়েরা হিজাব পরতো। এখনও অনেক খ্রিস্টান, ইহুদি নারী মাথায় স্কার্ফ পরে থাকে। একজন নারী মাথা কেমন করে ঢাকবেন সেটা তার বিষয়, আরব সংস্কৃতি অনুসারে মাথায় কাপড় পরা সম্রান্ত নারীর পরিচয় বহন করে। কারও হিজাব ভালো লাগলে হিজাব পরবে কিংবা কেউ চাদর দিয়ে ঢেকে রাখলে ঢেকে রাখবে সেটা তার সংস্কৃতি ও পরিবেশ বিচারে তার ইচ্ছা। পবিত্র কোরআনে চাদরের কথাই বলা আছে। তবে মাথা ঢাকলেই পর্দা হয়ে যায় না। কিংবা পরুষরা সঠিকভাবে কাপড় পরলেই পর্দা হয়ে যায় না। চোখের পর্দা হচ্ছে বড় পর্দা, প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করে অনাচারকে দূরে রাখার জন্য মনের পর্দা তৈরি করা হচ্ছে আসল পর্দা। পর্দা করলে আল্লাহ্ নির্দেশনা মানার জন্য করতে হবে। লোক দেখানো পর্দার করলে কোন লাভ নাই।

ইসলাম মানুষকে ভদ্র ও শালীনতা নিশ্চিত করার জন্য পোশাকের কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। এমন পোশাক পরবেন না যার কারণে আপনার গুপ্ত অঙ্গের আকার, আকৃতি বাইরে থেকেই দেখা যায়। যা মানুষের জন্য বিব্রতকর হয়। আবার পোশাক বিষয়ে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়িও করবেন না। বাড়াবাড়ি করে আপনি আপনার ধর্মের দর্শনকে শুধুমাত্র পোশাকে সীমাবদ্ধ করবেন না। কেউ অশালিন পোশাক পরলে তাকে এড়িয়ে চলুন। পরিচিত হলে বুঝিয়ে বলুন। তার কৃতকর্মের জন্য তাকেই ফল ভোগ করতে হবে। তার কর্মের জন্য আপনার কিছু হবে না। অনেক ঘেটেঘুটেও আপনি ইসলামি কোন বিশেষ ইউনিফর্ম পাবেন না যা ইসলামি ইউনিফর্ম। কারণ নবী মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ মানুষ তিনি ইসলামকে সামান্য পোশাকে আটকে রাখতে চাননি। তিনি তাঁর রবের নির্দেশে মানুষের জীবন পরিচালনার সুন্দর দিক দর্শনের কথাই বলে গেছেন।

Leave a Comment