ভাষা শেখার নানা কৌশল

ভাষা শেখার নানা কৌশল
মানুষের কণ্ঠ থেকে নিসৃত বাক সংকেতের অর্থবোধক সংগঠনকে ভাষা বলা হয়। অর্থবোধক ধ্বনির সংকেতের মাধ্যমে ভাব প্রকাশের মাধ্যমই হল ভাষা। একেক দেশের ভাষা একেক ধরণের। কিছু দেশ আছে- সেই দেশের ভাষা মাত্র একটি। কিন্তু পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে তাদের ভাষা একাকধিক। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৭১১১ টি ভাষা রয়েছে। যদিও পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা মাত্র ২৪টি ভাষায় কথা বলে থাকে। পৃথিবীতে এখন প্রায় ২৮৯৫টি ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার পথে। অনেক ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীর শীর্ষ ৭টি ভাষা হচ্ছে।
১. ইংরেজি
২. মেন্ডারিন
৩. হিন্দি
৪. স্প্যানিশ
৫. ফ্রেন্স
৬. আরবি
৭. বাংলা

পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার মানুষ তার নিজ ভাষায় কথা বলতে ভালোবাসে। কিন্তু পৃথিবীতে সব ভাষার মানুষই অন্য ভাষায় মত প্রকাশের জন্য দ্বিতীয় ভাষাকে বেছে নেয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে বেছে নেওয়ার কারণে ইংরেজি ভাষা অন্যান্য ভাষা থেকে বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশের মানুষও ভাষা শেখার ক্ষেত্রে ইংরেজিকে তাদের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শেখে। কিন্তু অনেক বছর কলেজে, স্কুলে ইংরেজি ভাষা শেখার পরও বাংলাদেশের মানুষ ভালো করে ইংরেজি বলতে পারে না। দেশের রাজধানী কেন্দ্রিক ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রদের কথা বাদ দিলে সারা বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারে বাংলাদেশের শিক্ষিত মানুষ খুবই দুর্বল। অথচ ইংরেজি বলার মত শব্দ ভান্ডার ও দক্ষতা একজন স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয় না।

ভাষা শেখা ও প্রয়োগের থেকে নাম্বার পাওয়ার জন্য কিছু মুখস্ত বিদ্যা কাজের লাগায় শিক্ষক ও ছাত্ররা। যার ফলে একটি ভাষা ১০ বছর পড়ে ও লিখেও ভাষাটাকে ভালোভাবে বলতে ও লিখতে পারে না। আরবি ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও তাই। একজন মানুষ ভালো কোরআন পড়তে পারলেই হল। কিন্তু সে ভালো কোরআন পড়তে পারলেও আরবি ভাষা বুঝেও না, বলতেও পারে না। যদিও না বুঝে ধর্মগ্রন্থ পড়ার মাঝে এক ধরণের পারলৌকিক উপকার আছে এই বলে সুখ নেওয়া যায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। তাই কোন ভাষা শিখলে সেই ভাষা বলা ও লেখার দক্ষতা অর্জন করার চেষ্টা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষের নিজ ভাষা ভালোকরে শেখার পাশাপাশি ইংরেজি ও আরবি ভাষা শেখা প্রয়োজন। এই শেখা শুধু পড়তে পারা নয়। এই শেখা মানে পড়তে পারা, বলতে পারা, বুঝতে পারা ও লিখতে পারা।

আমাদের দেশ থেকে প্রচুর মানুষ বিদেশে কাজ করতে যান। যদিও মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রম বাজার বেশ বড়, মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে আরবি ভাষা প্রচলিত। আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে হয়তো সামান্য পরিবর্তন আছে তবে একটি মান ভাষা শিখে গেলে মাধ্যপ্রাচ্যের যে কোন দেশেই তা কাজে লাগবে। আমাদের দেশের মানুষ যদি ভালো ইংরেজি ও আরবি বলতে পারে তবে তার শ্রমবাজরে আরও বেশি মূল্য বেড়ে যাবে। আমরা শুনেছি যে, ভাষার অদক্ষতার কারণে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষিত মানুষ নিম্নমানের কাজ করে থাকেন। ইংরেজি ও আরবি ভাষা শিখে বিদেশে কাজে গেলে সেই মানুষ যোগাযোগের ক্ষেত্রে আর দশটা মানুষের থেকে আলাদা হয়ে পরিচিত হবেন।

দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চাইলে যে দেশে যেতে চাইছেন সে দেশের ভাষা ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি শেখা উচিত। আপনি যদি একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারেন কিংবা যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন এই দক্ষতা আপনার বিশেষ দক্ষতা হিসেবে যোগ হতে পারে। ভাষায় দক্ষ হওয়ার জন্য কিছু কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই কৌশলগুলো নির্ধারণ করার পর প্রতিদিন চর্চা করতে হবে এভাবে আপনি আপনার পছন্দের ভাষায় কথা বলতে পারবেন বা যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন। নিয়মিত চর্চা না করলে শেখা ভাষাও আপনি ভুলে যাবেন। সুতরাং যে ভাষা শিখবেন সে ভাষা নিয়মিত চর্চা করতে হবে। ভাষা শিখলে যে বিষয়গুলো আপনার বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন তা হল-

১. শুনতে হবে ও বলতে হবে
২. নিজের মত করে লিখতে হবে
৩. নুতন শব্দ শিখুন ও ব্যবহার করুন
৪. কান তৈরি করার জন্য হেডফোন দিয়ে অডিও শুনুন
৫. যে ভাষা শিখতে চান সে ভাষার শিশুতোষ বই পড়ুন
৬. সাবটাইটেল যুক্ত ভিডিও দেখুন
৭. যে ভাষা শিখতে চান সেই ভাষার চলচ্চিত্র দেখুন
৮. প্রযুক্তির ব্যবহার করুন
৯. নিজে যা শিখলেন তা ভিডিও করুন

১. শুনতে হবে ও বলতে হবে
মুখের জড়তা ভাঙ্গার জন্য যেমন বলতে হবে তেমন শুনতে হবে। একটি ভাষা শেখার জন্য লজ্জা ভেঙ্গে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে ভাষা শেখার প্রথম অধ্যায়। একটি শিশু প্রথমেই ভাষা বলতে পারে না। ভাষা শেখার জন্য আপনাকে শিশুর মত করে শিখতে হবে। লজ্জা পাওয়া যাবে না। যে ভাষা শিখতে চাইছেন সে ভাষায় একটু একটু করে কথা বলা শুরু করুন। যতটুকু শিখেছেন ততটুকু দিয়েই কথা বলুন। ভাষা শেখার জন্য আপনার একজন সঙ্গী নির্বাচন করুন। সঙ্গী না পেলে নিজে নিজে সঙ্গী হয়ে নিজের সাথে কথা বলতে থাকুন। কোথায় আটকে যাচ্ছেন সেই বাক্যটা কীভাবে বলতে হয় তা একজন দক্ষ মানুষের কাছ থেকে জেনি নিন এবং ব্যবহার করুন।

২. নিজের মত করে লিখতে হবে
যে ভাষা শিখছেন সেই ভাষায় আপনার মনের ভাব প্রকাশের জন্য আপনার গল্প লিখুন। প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা একটু একটু করে লিখতে থাকুন। লিখতে লিখতে আপনি শব্দ ব্যবহারের কৌশল শিখে যাবেন। ভাষা শেখার জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে কাল। মানুষ তিনটি কাল নিয়েই তো কথা বলে! সুতরাং একটি ভাষায় সেই কালগুলো সম্পর্কে কীভাবে একটি শব্দ রচনা করে সে সম্পর্কে তিনটি বাক্য প্রথমে লিখুন। মানুষের অতীত চলে গেছে, মানুষের বর্তমান আছে এবং ভবিষ্যৎ আসবে। এই সিকুয়েন্স মাথায় বসিয়ে নিন। প্রথমে অতীত কালের একটি বাক্য লিখুন, তারপর বর্তমান কালের একটি- এভাবে ভবিষ্যৎ কালের একটি।

৩. নতুন নতুন শব্দ শিখুন ও ব্যবহার করুন
একটি বাক্য গঠনের কৌশল জানার সাথে সাথে আপনাকে শিখতে হবে নতুন নতুন শব্দ। শব্দ ভান্ডার সমৃদ্ধ না হলে আপনি ভালো করে আপনার মনের ভাব আপনি প্রকাশ করতে পারবেন না। আপনি প্রথমে ভেবে বের করুন প্রতিদিনকার চলার পথে আপনি আপনার নিজ ভাষায় কোন কোন শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকেন। সেই শব্দগুলো আপনি যে ভাষা শিখতে চাইছেন সে ভাষায় শব্দগুলো খুঁজে বের করুন এবং শিখুন। শেখার পর আপনার বাক্যগঠন প্রক্রিয়ায় এই শব্দগুলোর সংযোগ ঘটান। দেখবেন নতুন শব্দ শেখার পর তার ব্যবহারের ফলে আপনি সেই শব্দটি সহজেই মনে রাখতে পারছেন।

৪. কান তৈরি করার জন্য হেডফোন দিয়ে অডিও শুনুন
কান তৈরি করার জন্য যে ভাষা শিখতে চাইছেন সেই ভাষার বিভিন্ন অডিও কানে হেডফোন লাগিয়ে শুনুন। এতে করে সেই ভাষাকে আপনি ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। আপনার সেই ভাষা শোনার পর বুঝার ক্ষমতা বেড়ে যাবে। এর ফলে আপনি সেই ভাষায় করা যে কোন প্রশ্ন আপনি সহজেই বুঝে যাবেন তাতে করে আপনার প্রাসঙ্গিক উত্তর দেওয়াও সহজ হয়ে যাবে। অনেকেই ভাষা জানার পরও সঠিক সময়ে সঠিক প্রশ্নের উত্তর করতে পারেন না- কান তৈরি না হওয়ার কারণে। কান তৈরি হলে আপনাকে আর বিব্রত হতে হবে না।

৫. যে ভাষা শিখতে চান সে ভাষার শিশুতোষ বই পড়ুন
ভাষা শেখার ক্ষেত্রে প্রধান সহায়ক হয় শিশুদের সাথে কথা বলা ও শিশু সাহিত্য। যদি নতুন কোন দেশে আপনি যেয়ে থাকেন তবে সেই দেশের ভাষা শিখতে চাইলে শিশুদের সাথে আপনার বেশি কথা বলা উচিত। কারণ শিশুরা সব সময় সরল ও সহজ শব্দ ভান্ডার দিয়ে তাদের ভাব প্রকাশের বাক্যগুলো সাজায়। তাছাড়া শিশুদের জন্য লেখা সাহিত্য পাঠ করেও আপনি ভাষার শব্দ ও বাক্য গঠনের কৌশলগুলো রপ্ত করতে পারেন।

৬. সাবটাইটেল যুক্ত ভিডিও দেখুন
বিভিন্ন সাবটাইটেল যুক্ত ডকুমেন্টারি দেখুন। সাবটাইটেল আপনার সেই ভাষা বুঝতে সহায়ক হবে। এভাবে আপনি নতুন ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠবেন।

৭. যে ভাষা শিখতে চান সেই ভাষার চলচ্চিত্র দেখুন
একটি চলচ্চিত্রে সেই ভাষার আবেগ প্রকাশের অন্যতম মাধ্যমে। চলচ্চিত্রে সেই ভাষার মানুষের সংস্কৃতি যেমন জানা যায় তেমন জানা যায় সেই ভাষা তারা কেমন করে ব্যবহার করে থাকে। ভাষা ব্যবহারের কৌশল, আবেগ প্রকাশের উন্নত কৌশল শেখার জন্য যে ভাষা শিখতে চাইছেন সে ভাষার চলচ্চিত্র আপনার জন্য অনেক বেশি সহায়ক হতে পারে।

৮. প্রযুক্তির ব্যবহার করুন
ভাষা শেখার জন্য নতুন নতুন শব্দ ও কৌশল খুঁজে বের করতে প্রযুক্তির সহায়তা নিতে পারেন। অনলাইনে বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে ভাষা শেখার জন্য। নতুন নতুন শব্দ শেখার জন্য অনলাইন অভিধানের সহায়তা নিতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে অনলাইনে উচ্চারণও জেনে নেওয়া যায়। গুগল ট্রান্সলেটের মাধ্যমে অনেক সময় আপনি সঠিক শব্দ খুঁজে নিতে পারেন। ইউটিউবে ভিডিও দেখে দেখে আপনি আপনার নতুন ভাষা শোনা ও বলার চর্চা করতে পারেন।

৯. নিজে যা শিখলেন তা ভিডিও করুন
যতটুকুই শিখেছেন তা আপনার মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করে ফেলুন। এভাবে প্রথমদিকে এক মিনিট বলতেই হয়তো কষ্ট হবে তবে চর্চা করতে করতে তিন চার মিনিট বক্তব্য করতে পারবেন। যা বলবেন তা ভিডিও করুন। নিজে মনযোগ দিয়ে দেখুন। ভালো করে খুঁজে দেখুন বলার ক্ষেত্রে আপনি কোথায় কোথায় ভুল করেছেন। এভাবে আপনি নিজেই নিজের ভুল ধরতে পারবেন। এবং বুঝতে পারবেন কোথায় কোথায় আপনার আরও উন্নতি করতে হবে। এভাবে চর্চা করতে করতে দেখবেন আপনার নতুন শেখা ভাষায় আপনি বেশ সুন্দরভাবে, সাবলিলভাবে আপনার ভাব প্রকাশ করতে পারছেন। লিখতে পারছেন। বক্তব্য প্রদান করতে পারছেন। ঠিক এভাবে ম্যাজিকের মত করে আপনি ভাষা শিখে নিতে পারেন।

সুতরাং কাল থেকে শুরু করবেন? না! আজই শুরু করুন। কাজকের জন্য ফেলে রেখে আমাদের অনেক কাজই করা হয়নি। কাল চলে গিয়ে ভবিষ্যতে যেয়ে হায় হায় করছেন আহা গতকাল যদি শিখে নিতাম, গতকাল যদি করতাম তবে আজ এমন হত না। কালের ঘর বন্ধ রেখে আপনিও ভাবুন ভাষা শেখার আর কী কী কৌশল গ্রহণ করে আপনি ভালোভাবে ভাষা শিখতে পারেন। তবে আজ থেকেই শুরু করুন।

Leave a Comment