সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং (এসএমএম): এটি কীভাবে কাজ করে, এর সুবিধা ও অসুবিধাগুলো কী কী

সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং কী বা এর সম্পর্কে আমাদের ধারণা।

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং শব্দটি বেশ পরিচিত একটি বিষয়। এটি ডিজিটাল মার্কেটিং বা ই-মার্কেটিং নামেও বেশি পরিচিত। সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে নেটওয়ার্ক বিস্তার করে নির্দিষ্ট ব্রান্ডের তথ্য শেয়ার করে বাণিজ্য পরিচালনাই সহজ বাংলায় সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং। এটি কোম্পানির ব্র্যান্ড তৈরি করতে, পণ্যর বিক্রি বাড়াতে এবং ওয়েবসাইটে ট্র্যাফিক আনতে সহায়তা করে।

সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহার করে কোম্পানিগুলো তার গ্রাহকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। পণ্য সম্পর্কে গ্রাহকদের সরাসরি মতামত গ্রহণ করতে পারে যা বাজার বিশ্লেষণ ও পণ্যর গ্রাহক পর্যায়ের চাহিদা সম্পর্কে ডাটা সংগ্রহ ও অ্যানালাইসিস করা সহজ হয়ে যায়। যা পরবর্তীতে পণ্যর প্রচার ও বিক্রি বাড়াতে সহায়তা করে থাকে।

ইন্টারনেট এর ব্যবহারকারী বৃদ্ধি এবং ইন্টারঅ্যাকটিভ ডিজিটাল চ্যানেলের বৃদ্ধির ফলে সামাজিক মডিয়ার স্তর এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যা টেলিভিশন ও রেডিও এমনকি ছাপানো বা অনলাইনভিত্তিক নিউজপেপারগুলোকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। 2023 সালে সারা বিশ্বে ৪.৭৬ বিলিয়ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী ছিল- যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫৯%। ভাবা যায়!

সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারকারী ৮০% ভোক্তা জানিয়েছেন যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা সামগ্রী একজন ক্রেতার পণ্য ক্রয়ের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, একে সঠিকভাবে ব্যবহার না করতে পারলে আপনার পণ্য প্রচার ও সফল হওয়ার মাত্রা কম হবে। এটি প্রতিদিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং আমরা কেন করবো?

ক. সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এর ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমে বা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, এক্স (সাবেক টুইটার, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, মাইস্পেস ইত্যাদি ব্যবহার করে পণ্য বা সেবাগুলো বাজারজাত করার জন্য, বিদ্যমান গ্রাহকদের সাথে যুক্ত হতে এবং নতুনদের কাছে পৌঁছাতে ব্যবহার করবো।
খ. সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে পণ্য বিপণনের বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারবো। যা থেকে পণ্য প্রচারে কীভাবে গ্রাহকের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে হবে, গ্রাহকের চিন্তার মিথস্ক্রিয়া কী এবং গ্রাহক কী ধরনের পণ্য পছন্দ করছে ইত্যাদি।
গ. সামাজিক মাধ্যমে ব্যবসার প্রচার ভোক্তাকে পণ্য ক্রয়ে প্রভাবিত করছে। তাই সামাজিক মাধ্যমে এমনভাবে বিষয়বস্তুকে প্রচার করা যা ব্যবহারকারীর সাথে সহজে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
ঘ. সামাজিক মাধ্যমে যেহেতু মানুষ আছে এবং তারা একটা সময় সেখানে ব্যয় করে থাকে। তাই প্লাটফর্মগুলো ব্যবহার করে ব্যবসার প্রচার বাড়ানো খুবই সহজ হয়ে পড়েছে। এটি ব্যবসার জন্য প্রচার খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ঙ. সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের বিষয়টি সহজ ও কম খরচে হয়ে থাকে। যা একটি ব্যবসার জন্যে সাশ্রয়ী হয়। কিন্তু সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।

কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং কাজ করে?

সামাজিক মাধ্যমগুলো ভোক্তার আচরণকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। তাই ভোক্তাদের উদ্দেশ্যে এমন বিষয়বস্তু প্রচার করা যা তার ব্যস্ততার ভিতরেও তাকে চালিত করে। ভোক্তা কোন পণ্য সম্পর্কে জানতে চাইলো সাথে সাথে তাকে ম্যাসেজের মাধ্যমে অনুরোধ করা সে আপনার কাছ থেকে আরও কিছু জানতে চাইছে কী না। এই সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আপনার পণ্যে বিক্রি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। সামাজিক মাধ্যমে আপনার পণ্যকে কীভাবে প্রচার করতে চাইছেন, আপনার টার্গেট গ্রুপ কারা সে বিষয়ে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করুন এবং সেভাবে কাজ করুন।

১. আপনার ব্যবসার উদ্দেশ্য কী তা পরিষ্কার করুন।
২. আপনার লক্ষিত গ্রহাক কারা, তার বয়স, অবস্থান, আয়, আগ্রহ এবং সেই অনুসারে শিরোনাম ঠিক করুন এবং জানুন।
৩. আপনার ব্যবসার প্রতিযোগীদের একটি তালিকা করুন এবং বিশ্লেষণ করুন যে তারা কীভাবে সফল হচ্ছে।
৪. আপনি যদি সামাজিক মাধ্যমে বর্তমানে ব্যবসা করার চেষ্টা করে থাকেন তবে তার সফলতা ও ব্যর্থতাগুলো বিশ্লেষণ করুন।
৫. সামাজিক মাধ্যমে বিপণনের জন্য একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করুন: যেমন আপনার গ্রাহক আপনার কাছে কী ধরনের পণ্য কখন চাইছে ইত্যাদি।
৬. আপনার আগ্রহ বিচারে সেরা বিষয়টি নির্বাচন করুন সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এর জন্য।
৭. বিভিন্ন সময়ে সময়ে আপনার কৌশলের কর্মক্ষমতা যাচাই করুন। দেখুন এই কৌশলটি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। পণ্য প্রচারে ও সেবা প্রদানে সততাকে মূল বিষয় হিসেবে দাঁড় করানো। অনেক মানুষ দীর্ঘ সময়ের জন্য সফল হতে পারে না শুধু প্রতারণামূলক পদ্ধতিকে গ্রহণ করার জন্য। গ্রাহকের বিশ্বাসের একটা চিড় ধরলে সে আর ভুলেও আপনার দিকে আসবে না বরং আপনার পণ্যর নেতিবাচক প্রচারণা করবে।

গ্রাহক সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা

গ্রাহক থেকে গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পারার যে সুবিধা সেই সুবিধার কারণেই সামাজিক মাধ্যমে ব্যবসা সহজতর হয়ে উঠেছে। কাস্টমারের সাথে দ্রুত যোগাযোগ সামাজিক মাধ্যমে ব্যবসার অন্যতম বিষয়। গ্রাহকদেরকে মূল্য দিতে হবে, গ্রাহকের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। গ্রাহক যেন জানতে পারে তাকে যথেষ্ট সম্মান প্রদান করা হয়েছে। গ্রাহকের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন সমাজিক মাধ্যমে ব্যবসায় সফলতা নিয়ে আসে।

শেয়ারযোগ্য কনটেন্ট তৈরি করুন

যে কোন কনটেন্ট তৈরি করার ক্ষেত্রে গ্রাহকের ভাবনাকে কাজে লাগাতে হয়। এমনভাবে কনটেন্ট তৈরি করুন যা একজন গ্রাহক তার প্লাটফর্মে শেয়ার করতে আগ্রহী হয়। কোন উৎসবে, কোন দিবসকে সামনে রেখে আপনার পণ্যর প্রচার এমনভাবে করুন যাতে করে আপনার কনটেন্ট অন্যরা শেয়ার করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এমন একটি ভিডিও, বা গ্রাফিক্স যা মানুষকে আন্দোলিত করে এবং প্রভাবিত করে তা শেয়ার করতে। যা পরোক্ষভাবে আপনার বিজ্ঞাপন প্রচারে সুবিধা হয়।

আপনার পণ্যের ওপর ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করতে পারেন। যেখানে একটি গল্প থাকবে। যে গল্প মানুষকে ও মানুষের হৃদয়কে প্রভাবিত করবে। এভাবে আপনি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে যাবেন। যখন এমনটি হবে তখন দেখবেন মানুষই আপনার হয়ে অবশিষ্ট কাজটি করে দিচ্ছে।

অন্যের মাধ্যমে রিভিউ আদায় করে নেওয়া

বিভিন্নভাবে কাস্টমারকে উৎসাহ প্রদান করতে পারেন আপনার পণ্য সম্পর্কে রিভিউ প্রদান করার জন্য। গ্রাহকের সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে পারেন। ভালো রিভিউ প্রদানকারীকে আপনি প্রণোদনা প্রদান করতে পারেন। এবং সেই প্রণোদনার খবর প্রচার করতে পারেন আপনার পেজে। ভালোভাবে গ্রাহকের এই অর্জনকেও আপনি প্রচার করতে পারেন। এতে পরোক্ষভাবে আপনার পণ্যের সাথে গ্রাহকের মজবুত সংযোগ স্থাপন হবে।

ভাইরাল মার্কেটিং

কোন একটি কনটেন্টকে অধিক মাত্রায় প্রচারের বিষয়বস্তু সংযোগ করে অধিক শেয়ারের মাধ্যমে ভাইরাল করে বিপণন করা হচ্ছে ভাইরাল মার্কেটিং। বিষয়টি এখন খুব সস্তা টার্মে পরিণত হয়েছে। ভাইরাল মার্কেটিং অনেক সময় সেল বাড়িয়ে দেয় তবে অনেক সময় বিক্রির স্থিতাবস্থা ধরে রাখতে পারে না।

সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এর সুবিধা ও অসুবিধাগুলো কী?

সুবিধা
সামাজিক মাধ্যমগুলো একটি বৃহৎ মানুষের কাছে পৌঁছাতে সহায়তা করে। যা মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করতে পারে। একটি ব্রান্ড সচেতনতা বাড়াতে এবং পণ্যের স্বীকৃতি বাড়াতে এটি খুব ভালো কাজ করে। গ্রাহকের কাছ থেকে সহজেই নানা ধরনের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে বিক্রয়ের কৌশল নির্ধারণ করা যায়। এই মাধ্যমে মার্কেটিং কম ব্যয়বহুল। কারণ সাধারণ পদ্ধতিতে বিজ্ঞাপন প্রচার খুবই ব্যয়সাপেক্ষ বিষয়। ছোট ব্যবসার জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং খুব দারুণ বিষয়।

এই মাধ্যম ব্যবহার করে আপনার ওয়েবসাইট বা ব্লগের লিংক শেয়ার করে তার মাধ্যমে আপনার ওয়েব সাইটের পরিচিতি বাড়াতে বা ট্র্যাফিক আনতে পারেন। তাছাড়া রিয়েলটাইম গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা দেয় এই মিডিয়া। যার মাধ্যমে আপনার পণ্যর একটি টেকসই ব্রান্ড ভ্যালু তৈরি হয়। গ্রাহকরা যখন অন্য নতুন গ্রাহকের কাছে আপনার পণ্যর লিংক শেয়ার করে তখন অন্য গ্রাহক বিবেচনা করে এই প্রচারণা সত্য এবং এই সেবা গ্রহণ করা যায়।

অসুবিধা
সামাজিক মাধ্যমে সবসময় লেগে থাকতে হবে। একটি শক্তিশালী সামাজিক মাধ্যমে নেটওয়ার্ক বিল্ডিংয়ে সময়ের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া এর জন্য প্রয়োজন বিশেষ দক্ষতারও। ব্যবসার মালিককে গ্রাহকের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়। নতুন নতুন প্রচারের কনটেন্ট তৈরি করতে হয় যা অনেকের জন্য ঝামেলা মনে হয়। সামাজিক মাধ্যমকে গভীরভাবে বোঝা বা আকর্ষণীয়ভাবে বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করাও অনেকের কাছে সহজ হয়ে ওঠে না। অন্যদিকে ডেটা সংগ্রহ ও ডেটা বিশ্লেষণ করা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা একটি সিস্টেমেটিক পদ্ধতি যা অনেকের কাছে সহজবোধ্য না। প্রতিটি প্লাটফর্মের বিশেষ বিশেষ কিছু দিক আছে যা নিজেকেই বুঝতে হয়। অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যম ক্রমাগত তার নীতি পরিবর্তন করছে এই বিষয়গুলোর সাথেও খাপ খাওয়াতে হয়। বড় কোম্পানিগুলো এই বিষয়গুলোকে চালিত করার জন্য বিশেষায়িত একটি গ্রুপকে দায়িত্ব দিয়ে রাখে। কিন্তু ছোট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

সামাজিক মাধ্যমগুলো গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগের বিষয়টি সহজের পাশাপাশি গ্রাহকের অভিযোগ নেওয়া সহজ করে তোলে। এটি করতে যেয়ে অভিযোগগুলো জনগণের সামনে প্রচার হয়ে যায়। যা অনেকসময় নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে। একটি পাবলিক ফোরামকে সঠিকভাবে পরিচালনা না করতে পারলে প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

Leave a Comment